|| কন্সট্রেইন ||


০১.
বাসা থেকে ছোট একটা কারণে আম্মুর সাথে ঝগড়া করে বেড়িয়ে এলাম। ইদানিং আমার কি যে হয় তা আমি নিজেও বুঝি না। হাঁটতে হাঁটতে রেল লাইনের পাশে এসেই বসে পড়লাম। পাশেই খোলা একটা মাঠ। মৃদু বাতাস বইছে। ভালোই লাগছে। পকেট থেকে একটা ধুম্র শলাকা বের করে জ্বালিয়ে আনমনে ফুঁকছি। প্রতিটা চুমুতে মনে হচ্ছে আমার মগজের নিউরন সহস্রবার আন্দোলিত হয়ে ওঠে কোন এক অজানা বিপ্লবে। এইরকম ভালোবাসা তাকেই যায়, যে কিনা আমার দুঃখগুলোকে অতি সহজেই হালকা করে দিতে পারে। দুনিয়ার এ প্রান্ত থেকে শুরু করে ও প্রান্ত, আকাশ থেকে পাতাল সব যখন আমার ভাবনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠল ঠিক এমন সময় আমার চোখ পড়লো রেল লাইনের পাশে পরে থাকা একটি ডায়েরির উপর। অনেক সুন্দর মলাট। দেখেই কেমন যেন একটু কৌতূহল জেগে উঠলো আমার মনে। হাতে তুলে নিলাম।

০২.
০৪/০২/২০১২
আজকে অনেক মজা হল। আমি বাবা-মা, দিবা আর সুষমা আমরা সবাই মিলে অনেক ঘুরেছি। দিবা’র এবারের জন্মদিনটা আসলেই অনেক স্মরণীয়। সুষমা’র এস এস সি এক্সামটা হয়ে গেলে আমাদের আর বিচ্ছিন্নভাবে থাকতে হবে না। মা আর সুষমাও ঢাকা চলে আসবে। আর বাবাও ট্রান্সফার নিয়ে ঢাকা চলে আসবে। সবাই আবার একসাথে থাকবো।

১৩/০৪/২০১২
মানুষ এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হয়? বাবা এভাবে আমাদের ছেঁড়ে চিরদিনের জন্য একা একাই চলে গেলো কি করে? যে বাবা আমাদের ফেলে একা একা এক মুঠো ভাত মুখে দিতো না আর সে কিনা আমাদের সবাইকে বিপদের মাঝে ফেলে রেখে একা চলে গেলো না ফেরার দেশে !

১৯/০৫/২০১২
ছোট চাচা বাবার সব সম্পত্তিও নিজের বলে দাবি করছে। মানুষ কতো স্বার্থপর। ভাই মরে গেলো অমনি ভাইয়ের সবকিছু পর হয়ে গেলো শুধু সম্পত্তি ছাড়া ! মা আর বোনদের নিয়ে আমি একা এই শহরে কি করে বাঁচবো? বলে যাও বাবা।

২৭/০৬/২০১২
সুষমা আর দিবার কলেজ আর প্রাইভেট ফিস, বাসা ভাড়া এইসব যোগাড় করতে হবে। মাস প্রায় ফুরিয়ে এলো বলে। বাবার পেনশনের টাকা নিয়েও গড়িমসি করছে। কবে হাতে পাব জানি না। সময়ের কাছে আমি বন্দী। আমি চাইলেই পারি না আমি আমার বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতে। পৃথিবীতে অনেক কিছুই আমার মতের সাথে যাবে না, হয় আমাকে তার সাথে মানিয়ে নিতে হবে আর না হয় তাকে পরিত্যাগ করতে হবে !আমি পরিত্যাগ করতে পারবো না। শুধু নিজের জন্য হলে আমি পরিত্যাগ করতাম, কিন্তু এখানে আমার উপর আরও তিনজন মানুষের ভার পরে রয়েছে। আমি তাই পারবো না, কিছুতেই পারবো না। আমাকে বাধ্য হয়ে মানিয়ে নিতে হবে ! হ্যাঁ মানিয়ে নিতে হবে !!
ক্ষমা করো বাবা। তোমার নিশি আজ থেকে মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে !

০৩.
ডায়েরিটা বন্ধ করে নিউরনের আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করার প্রয়াসে আরেকটা ধুম্র শলাকা জ্বালালাম। ঘাসের উপর শুয়ে আকাশ দেখছি। এক সময় আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখতাম। এখন মনে হয় আমার জন্য আকাশ নয়। এতো কল্পবিলাসিতা জীবনে এখন আর মানায় না। এই বয়সে এসে একটু বাস্তববাদী না হলে আর হয় না। মোবাইলের রেডিওতে হালকা মেজাজে গান চলছে –
শুধু বিষ, শুধু বিষ দাও, অমৃত চাই না।
অমরত্যের লোভ, করুক বিক্ষোভ।
জীবনকে যদি দাও নীল বিষাক্ত ছোব
থাকবেনা থাকবেনা থাকবেনা ক্ষোভ।
আমার মৃতদেহে ঝুলবে নোটিশবোর্ড
কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।

০৪.
নিশিঃ আর পারবো না। দুজনের কথা বলে এখন তিনজন!
আসাদঃ ও হচ্ছে ডোনার তুমি ওকে না বলে দিলে কেন?
নিশিঃ তাহলে প্রথমে কে ছিল?
আসাদঃ আরে ওর ই তো ফ্ল্যাট !
নিশিঃ সে যাই হোক দুজনের কথা ছিল। আপনি আর সে করেছেন। এখন আর পারবো না। আমার টাকা দিন। আমি চলে যাবো।
আসাদঃ তুমি যাকে ভাগিয়ে দিয়েছো তার টাকা দেবার কথা ছিল। সে চলে গেছে। এখন টাকা দিবো কিভাবে? সব তোমার দোষ !
নিশিঃ এতো কিছু বুঝি না। আমার টাকা দিয়ে দিন। আর না হলে ভালো হবে না কিন্তু।
আসাদঃ এহহ চোট কতো ! দিমু না তোরে টাকা। কি করবি? নালিশ দিবি? যা দে যাইয়া।

নিশি কিছু না বলে চলে আসে। যে টাকার জন্য সম্ভ্রম ত্যাগ সেই টাকার চিন্তায় এখন মাথা খারাপ নিশির। মানুষ যে পশুর চেয়েও জঘন্য সে কথা জানা ছিল না নিশির। আজ সে বুঝতে পারছে জীবন কতোটা কঠিন। যে সমাজে পশুদের সঙ্গে বাস করতে হয় না চাইলেও ! নিশির চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে দু ফোঁটা। কোটি মানুষের ঝলমলে এই শহরে কেউ দেখে না নিশির চোখের এক ফোঁটা জল। বাতাসের মাঝে হারিয়ে সেই জল বাতাসের আদ্রতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়।

০৫.
উফফ… ধুম্রশলাকার শেষ প্রান্ত কখন যে আমার আঙ্গুল স্পর্শ করেছে খেয়াল ই করিনি। আরে আরিফ এদিকে আসছে কেন? নাহ এই ছেলেটা আমার পেছন আর ছাড়লো না। নিশ্চয়ই আম্মু আমায় খুঁজতে ওকে পাঠিয়েছে আর ও আমায় খুঁজতে এই পর্যন্ত চলে এসছে ! ওর মতো বন্ধু পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। দুজন মিলে আবার হাঁটা দিলাম বাসার দিকে। হঠাৎ আরিফ আমাকে বলে, “আরমান ওদিকে দেখ!” আমি তাকাতেই দেখি এক যুবতির লাশ ট্রেনে কাটা পরে দ্বিখণ্ডিত হয়ে আছে লাইনের পাশে!
আরিফকে শুধু বললাম থাক চল বাসায় যাই। এ তো নিত্য দিনের খবর!
মনে মনে বির বির করে বললাম –

নাস্তিকেরা তোমায় মানে না, নারী
দীর্ঘ-ঈ-কারের মতো তুমি চুল মেলে
বিপ্লবের শত্রু হয়ে আছো !

 

About একজন আরমান

জীবনটা হল এক রঙ্গমঞ্চ। আর আমরা সবাই হলাম সেই মঞ্চের অভিনেতা / অভিনেত্রী!
This entry was posted in অল্প স্বল্প গল্প.......... Bookmark the permalink.

মন্তব্য করুন